সোহেল সানি:
ওবায়দুল কাদের, একভাগ্য জয়ী নেতা। তিনি ছাত্রলীগের ইতিহাসে একমাত্র সভাপতি, যিনি আওয়ামী লীগের দু-দুবার সাধারণ সম্পাদক। তাঁর উত্থানের গল্পটা যেন রূপকথার গল্প। নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের রাজাপুর গ্রামের শিক্ষক মোশাররফ হোসেনের পুত্র একদিন রাজনীতির ‘রাজপুত’ হয়ে যাবেন- কে জানতো?
ছাত্রলীগের একমাত্র সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের দু-দুবার সাধারণ সম্পাদক। দ্বিতীয় মেয়াদে আব্দুর রাজ্জাক ‘৮৩ সালে বহিস্কার হন। ‘৯২ সালে ফিরে এলেও শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব মেনে নিয়েই পথ চলতে হয় তাঁকে। ‘ওয়ান ইলেভেন’ কেন্দ্র করে আমু-তোফায়েল ও সুরঞ্জিত-জলিলের মতো রাজ্জাককেও ছিটকে পড়তে হয় প্রেসিডিয়াম থেকে।
‘৫০ সালে জন্ম নেয়া কাদের ‘৬৭-তে নোয়াখালী কলেজ। ওখান থেকেই ছাত্রলীগের সংস্পর্শে আসা। যখন ৬ দফার আন্দোলন তুঙ্গে। সিরাজুল আলম খান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আসম আব্দুর রব, ছাত্রলীগের ত্রিরত্নই বৃহত্তর নোয়াখালীর। ওবায়দুল কাদেরের মানস-গঠনে এসবই প্রভাব রাখে। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার আন্দোলন ওঠা ‘৬৯ গণঅভ্যুত্থান। এ সময় উঠতি কর্মী ওবায়দুল কাদের। তোফায়েল ডাকসু ভিপি হওয়ার পর ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব। রব পরে ডাকসু ভিপিও হন। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফা খ্যাত ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের সময়ে রাজনীতিতে বেড়ে ওঠা কাদেরের।
‘৭১-এ কোম্পানিগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পদে না থাকলেও স্বাধীনতাত্তোর ছাত্রলীগের ভাঙ্গন তার চোখের সামনে। ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে।একটি শেখ ফজলুল হক মনি আশীর্বাদিত নূরে আলম সিদ্দিকী- আব্দুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপ এবং অপরটি সিরাজুল আলম খান আশীর্বাদিত আসম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ গ্রুপ। ‘৭২ সালের ১৯ জুলাই মুজিববাদ পন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থীরা পল্টন ময়দানে সম্মেলন ডাকে। বঙ্গবন্ধু দুটি সম্মেলনের প্রধান অতিথি। এর আগে শাজাহান সিরাজকে সরিয়ে ইসমাত কাদির গামাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। যা হোক বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলে। সিরাজুল আলম খান পন্থী ছাত্রলীগ জাসদের অংশ হয়।এদিকে ডাকসু ও হলগুলোর নির্বাচন। মোহসীন হল ছাত্র সংসদ ছাত্রলীগ প্রার্থী মনির-শরফুদ্দিন। কাদের তখন ‘রশিদ-কাদের’ প্যানেল করে। এ প্যানেলটি পরে ছাত্রলীগ জাসদ রূপে গণ্য হয়। ডাকসুতে ছাত্র ইউনিয়নের কাছে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপই হারে। কাদের নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা বেলায়েতের শরণাপন্ন হন। তাকে বেলায়েত নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘৭৩-‘৭৪- এ ছাত্রলীগের সম্মেলন। মনিরুল হক চৌধুরী সভাপতি, শফিউল আলম প্রধান সাধারণ সম্পাদক হলে ওবায়দুল কাদের দফতর সম্পাদক হন। ৭৪-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেভেন মার্ডার’-কে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগে চরম অবস্থা। সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান বহিষ্কারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে। দফতর সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ঝুঁকি নিয়েই এ বার্তা প্রচার করতে হয়। মোহসীন হলের ছাত্র হলেও থাকতেন জহুরুল হক হলে মোক্তালিব টুকুর রুমে। ছাত্রলীগ কর্মী টুকু পরে কাস্টমে। ৭৫ ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হয় জাতীয় ছাত্রলীগ। মানে বাকশাল’র অঙ্গফ্রন্ট। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ শহীদ হন জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু ৬ মাসের ব্যবধানে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।
ছাত্রলীগ নেতারা অনেকে কারারুদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করা ওবায়দুল কাদেরও কারাগারে।
‘৭৬-এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলন। ‘আউয়াল- জালাল’ ও ‘সরোয়ার-ফজলু’
দুটি গ্রুপ। ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী কোনো গ্রুপকেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হিসাবে মানলেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ হস্তক্ষেপ করলেন। তখন ছাত্রলীগের মধ্যে প্রভাব দুনেতার। দশ ছাত্রলীগ নেতাকে সমঝোতা নিয়ে আসতে দুই নেতা দলের ৬ নেতাকে দায়িত্ব দিলেন। সৈয়দ আহমদ, মোজাফফর হোসেন পল্টু, অধ্যাপক আলী আশরাফ, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও এস এম ইউসুফ হলেন এই ৬ নেতা। মোজাফফর হোসেন পল্টুর বিজয় নগরস্থ বর্ণালীপ্রেসে বসলেন নেতারা। কিন্তু কমিটি গঠনে সমঝোতা করাতে পারলেন না। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় দুটি গ্রুপ ‘জালাল- ফজলু’ এবং ‘আউয়াল- সরোয়ার’ এর নাম আসে। শেষ পর্যন্ত আউয়ালকে আহবায়ক ও সবাইকে সদস্য করে আহবায়ক কমিটি করা হয়। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হয় বাহালুল মজনু চুন্নুকে আহবায়ক করে।
‘৭৭ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলন ডাকা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। এখানেও দুটি প্যানেল জালাল- শামসুল হক এবং ফজলু- জাহাঙ্গীর। তিনদিন পার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এলিফ্যান্ট রোডের পীর সাহেবের বাড়িতে নিয়ে গেলেন ফজলুর রহমান ও আখম জাহাঙ্গীরকে। দুই নেতাকে আব্দুর রাজ্জাক মাজার ছুঁয়ে শপথ করালেন ওবায়দুল কাদেরকে সভাপতি ও বাহালুল মজনু চুন্নু সাধারণ সম্পাদক হিসাবে মেনে নেয়ার জন্য। নেতার কথা মান্য করে ছাত্রলীগ নেতাদ্বয় গেলেন বটতলায়। বক্তৃতা করেও রাজী করানো গেলো না। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ গিয়ে সবাইকে মানাতে সমর্থ হলে ঘোষণা করা হয় সভাপতি পদে কারারুদ্ধ ওবায়দুল কাদের ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাহালুল মজনু চুন্নুর নাম।ওবায়দুল কাদের তোফায়েলের এবং চুন্নু রাজ্জাকের পছন্দে নেতৃত্বে উঠে আসেন। এরপর কয়েক নেতা কাপড়চোপড় ও ফুল নিয়ে ছুটেন ফরিদপুর কারাগারে। রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন খরচাপাতি দেন। কাদের কারামুক্ত হয়ে ছাত্রলীগের হাল ধরেন।দুবার ডাকসু নির্বাচনেও ভিপি প্রার্থী হন কাদের। ছাত্রলীগের সম্মেলন ‘৮১ সালে। এবারও গ্রুপ। ছাত্রলীগের দশ নেতার ভোটে নির্বাচিত করা হয় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক। ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সভাপতি হন ৬ ভোট পেয়ে। ফজলুর রহমান পান ৪ ভোট। আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন ৫ ভোট পেয়ে হন সাধারণ সম্পাদক।মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সভাপতি হন তোফায়েল আহমেদের পছন্দে আর আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন সাধারণ সম্পাদক হন তৎকালীন আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আমির হোসেন আমুর পছন্দে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই ছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন। ছাত্রলীগসহ নানা বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে তখন মতদ্বৈধতার সৃষ্টি হয় নেতৃত্বের শুরু থেকেই। এর জের ধরে ‘৮৩ সালের ৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিতসভা ডাকেন শেখ হাসিনা। আব্দুর রাজ্জাক ১৫ আগস্টের পরে এ বৈঠক ডাকার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় সভাপতির ক্ষমতাবলে এ বৈঠক ডাকেন শেখ হাসিনা। বৈঠকে সিদ্ধান্তক্রমে সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন এক নম্বর প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মালেক উকিল, প্রেসিডিয়াম সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মমিন তালুকদার ও দফতর সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ এবং শিক্ষা সম্পাদক এস এম ইউসুফকে বহিষ্কার করা হয়।
এই মতভেদের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২৯ জুন আব্দুর রাজ্জাকের বাসায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আব্দুল মালেক উকিল বলেন,” বংশানুক্রমে নেতা হওয়া যায় না- যদি তাই হতো, তা হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলাইমান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হতেন।” (সূত্র ৩০ জুন ‘৮৩ বাংলার বানী)
মূলত, ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক নিজ বাড়ির পাশে আলাদা দলের কার্যালয় স্থাপন করেন এবং দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চলে আসছিলো বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি। আব্দুর রাজ্জাক ৯ জনকে বহিষ্কার করেন এবং আওয়ামী লীগ (রাজ্জাক) নামে নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর পুনর্জীবন করেন মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেনও বাকশালে যোগ দেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম সংসদ নির্বাচনের আগে ন্যাপ (মোজাফফর) ত্যাগ করে মহিউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগে যোগদেন। ‘৭৪ সালের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর স্থলে এএইচএম কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি হলে মহিউদ্দিন আহমেদ সিনিয়র সহসভাপতির পদলাভ করেন। ‘৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দল রূপে যে বাকশাল আত্মপ্রকাশ করে, সেই বাকশাল নামটি মহিউদ্দিন আহমেদেরই দেয়া।
১৯৮৩ সালে রাজ্জাক বহিষ্কার হলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ‘১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি কাউন্সিলে সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ কমিটিতে ওবায়দুল কাদের ছিলেন নির্বাহী সদস্য।
১৯৯২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলের আগে বাকশাল আওয়ামী লীগে একীভূত হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, মোনায়েম সরকার, ফজলুর রহমান, মুকুল বোস নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। ওই কাউন্সিলে ওবায়দুল কাদের শিক্ষা সম্পাদক হন।
১৯৯৭ সালের ৬ মে কাউন্সিলেও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। ওবায়দুল কাদের এই কাউন্সিলে যুব ক্রীড়া সম্পাদক হন। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর কাউন্সিলে আব্দুল জলিল সাধারণ সম্পাদক ও ওবায়দুল কাদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই কাউন্সিলে বাদ পড়েন শীর্ষ প্রায় সব নেতা। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক হন। ওবায়দুল কাদের হন প্রেসিডিয়াম সদস্য।
২০১৩ সালের কাউন্সিলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের কাউন্সিলে এবং সর্বশেষ সর্বশেষ কাউন্সিলে ওবায়দুল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ওবায়দুল কাদের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হন। বর্তমানে তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে বেঁচে আসা ওবায়দুল কাদেরের বর্ণাঢ্য রাজনীতিতে আছে ওয়ান ইলেভেনের কারাবরণের তিক্ত স্মৃতি। আছে আরও একটা অতীত, তা হলো তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন একটা লম্বা সময়, অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বানীর সহকারী সম্পাদক হিসাবে।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Leave a Reply